স্বপ্নের চেয়েও বড় যে জন
প্রকাশিত : ১৮:৩২, ৩০ নভেম্বর ২০১৮
মানুষ তার স্বপ্নের চেয়েও বড় হয়। আর স্বপ্নই পারে মানুষকে বদলে দিতে, তার চারপাশকে বদলে দিতে। প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের প্রথম প্রয়াণ বর্ষ পূরণের দিনে এ ভাবনাটিই বারবার মাথায় ঘুরছে। প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক মেয়র প্রার্থী মনোনীত ও নির্দেশিত হওয়ার পরপরই তাঁর সঙ্গে যে কথোপকথন, তাতে আর যাই হোক, এই কথাগুলো `নগরপিতা` আনিসুল হক সম্বন্ধে ভাবব, তা মনে হয়নি। কারণ আমার `সত্য ভাবনায়` একজন ব্যবসায়ী নেতা তাঁর ওপর ন্যস্ত প্রধানমন্ত্রী আর জনমানুষের আস্থাকে `আমানত` হিসেবে নিয়ে দ্রুতই জনমানুষের নেতায় রূপান্তরিত হবেন- এ আমার বোধের অতীত, জানার নতুন অধ্যায়।
মেয়র নির্বাচনের প্রস্তুতির প্রাথমিক পর্যায় ছিল সমাজ, প্রতিষ্ঠান, জনমানুষ সংশ্নিষ্ট `সবার কাছ থেকে জানা` এবং সে অনুযায়ী `কৌশলপত্র` নির্ধারণ। এই সময়ে তিনি একনিষ্ঠ ছাত্রের মতো জেনেছেন, বুঝেছেন আর দ্রুত প্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন। এ সময় তাঁকে প্রণোদিত করায় তিনি বেশ কিছু অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ের সমীক্ষায় নেমে পড়েন। আর তার ফলাফলের ওপরে রচিত হলো তাঁর `সমস্যা চিহ্নিত, এবার সমাধান যাত্রা`র সেই মহাযজ্ঞ। নির্বাচনকালীন এই মহাযজ্ঞের সূচনায় তিনি অনুপ্রাণিত করলেন আপামর ঢাকাবাসীকে আর একদল পেশাজীবী, চিন্তাবিদ, বুদ্ধিজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষদের। নির্বাচন-পরবর্তী কয়েক মাসের প্রস্তুতির পর সবার সম্মিলিত শক্তি আর আগ্রহকে পুঁজি করে তিনি খাতওয়ারি অনেক উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে নতুন মাত্রায় `সমাধানযাত্রা`কে এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যয়ী উদ্যোগী হন।
প্রথমত ঢাকা শহরের যানজট নিরসনে স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনার অধীনে বাস-ট্রাক স্ট্যান্ডসহ সড়কগুলো দখলমুক্ত করার উদ্যোগ নেন। বেদখলের বিরুদ্ধে এক যুদ্ধংদেহী কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে তেজগাঁও সাতরাস্তা থেকে শুরু করে গাবতলী বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন সড়ক, গুলশান এভিনিউর শক্তিশালী বাণিজ্যিক গোষ্ঠী থেকে বিদেশি দূতাবাস কর্তৃক অবৈধ দখলকৃত ফুটপাত, বনানী কবরস্থান সংলগ্ন দখলকৃত জমিসহ বাড্ডার লেকপাড় সড়ক, প্রতিবন্ধকতাকারী ভবন ইত্যাদি `দখলমুক্ত` করে সেসব সম্পদের ওপর জনগণের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেন। তাঁর এ সফলতায় মানুষ শুধু তাঁকে সমর্থন জোগানোই নয়, উজ্জীবিত হয়েছে এক নতুন বিশ্বাসে। দীর্ঘমেয়াদে ব্যাপক সড়ক ও ফুটপাত, সেই সঙ্গে `সিগন্যালিং ব্যবস্থা` উন্নয়নের পাশাপাশি প্রায় ৫৭টি বাস রুটকে ৬-৭টি রুটে কোম্পানিভিত্তিক `একীভূত`করণের মাধ্যমে তিনি পরিশীলিত `বাসভিত্তিক` টেকসই ও মানসম্পন্ন `গণপরিবহন`-এর উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। দেনদরবারের মাধ্যমে সরকারের কাছ থেকে সহযোগিতা আদায় করেছিলেন। এই সহযোগিতার মাধ্যমে এ খাতের ব্যবসায়ীদের `সেবা`র মানসিকতায় উজ্জীবিত করতে পুরনো ও প্রায় বাতিল ৪ হাজার বাসের বদলে স্বল্প সুদে নতুন এবং বয়স্ক ও প্রতিবন্ধীবান্ধব বাস আমদানির উদ্যোগ গ্রহণ করেন। পাশাপাশি `করিডোর`ভিত্তিক যাত্রীসেবা নিশ্চিত করার জন্য ফুটপাত, যথাযথ বাসস্টপ, সিগন্যাল ব্যবস্থা, রোড মার্কিং ও সবুজায়নের একটি সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। গুলশান এলাকায় `ঢাকা চাকা`সহ ফুটপাত, সড়ক ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন ছিল তাঁর `পাইলট` উদ্যোগ। মহাখালী থেকে গাজীপুর পর্যন্ত `ইউলুপ` পদ্ধতিতে `সিগন্যালবিহীন` করিডোর উদ্যোগের মাধ্যমে `গতিশীল ও নিরাপদ` সড়ক তৈরিতে তিনি একটি আধুনিক ও যুগান্তকারী কার্যক্রম হাতে নিয়েছিলেন। পদচারীবান্ধব `র্যাম্পভিত্তিক` ফুটপাত যুক্ত করে এ উদ্যোগকে মানবিক রূপ দেওয়ার প্রচেষ্টা ছিল প্রশংসনীয়। কত রাত এ আলোচনায় তাঁকে আমরা প্রাঞ্জল ও উদ্বুদ্ধ হতে দেখেছি।
ঢাকা শহরের দৃষ্টিদূষণের বিরুদ্ধে প্রায় আন্দোলন গড়ে তুলে একটি যথাযথ `নীতিমালাভিত্তিক নতুন বিজ্ঞাপন ধারায়` নগরসজ্জাকরণের উদ্যোগ নেন। শুধু উত্তর ঢাকায় নয়; দক্ষিণের মেয়রকে নিয়ে একটি যুগপৎ `দৃষ্টিবান্ধব নগর` গড়ে তোলার লক্ষ্যে এক কার্যকর আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আমরা ক`জন দিনরাত এ কাজে তাঁর পাশে থেকেছি। আর যার সুফল অনেক দিন ধরে তাঁর অকালমৃত্যুর পরও এই ঢাকা শহরবাসী ভোগ করছে। তবে তাঁর সেই উদ্যোগে প্রণীত `নীতিমালা` আজও সরকারের অনুমোদনের অপেক্ষায়।
বায়ুদূষণের বিরুদ্ধে সবুজ ঢাকা আন্দোলনে নব নব উদ্যোগ আর উদ্যোগীরা তাঁর কাছে ছিল আদরণীয়। নগর বাগান, ছাদ বাগান ইত্যাদি আন্দোলনের পাশাপাশি `ট্যাক্স প্রণোদনা`ভিত্তিক উদ্যোগ নগরজীবনে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল।
ঢাকা শহরের জলজট আর জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রথমেই পরামর্শ সভা করলেন তিনি। তার পর উদ্যোগ গ্রহণে সচেষ্ট হলেন। জনজট ও জলাবদ্ধতা এর বহুমাত্রিক জটিলতায় স্বল্পমেয়াদি ব্যাপক ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নয়নের উদ্যোগগুলোকে সামলে নিয়ে `আমাদের কয়েকজন স্থপতি-পরিকল্পনাবিদকে` সম্পৃক্ত করে চারটি `বিশাল` প্রকল্প সরকারপ্রধানের নজরে আনেন। প্রধানমন্ত্রী তাতে সাড়া দিয়ে `প্রকল্প পরিপত্র` তৈরির উদ্যোগ নিতে বলেন। প্রকল্পগুলোর মধ্যে দ্বিগুণ মৌজায় `জল-নিসর্গ` প্রকল্প, যার পরিধি হাতিরঝিলের প্রায় সাড়ে তিনগুণ; এগুলোর সঙ্গে কল্যাণপুর `ক`, `খ`, `গ`, `ঘ` খালগুলোর সঙ্গে ওয়াপদার `জল সংরক্ষণ` অঞ্চল একটি `নগর জলউদ্যান` প্রকল্প আর হাতিরঝিল-বালু নদীর সংযোগ হিসেবে `নড়াই খাল` বা বনশ্রী খাল উন্নয়ন প্রকল্পগুলো উল্লেখযোগ্য। `জলবান্ধব` নগরী গঠনের লক্ষ্যে `ব্লু নেটওয়ার্ক` পুনরুদ্ধার কার্যক্রম প্রকল্পগুলো ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারত।
স্বপ্নবাজ মেয়রের অকালমৃত্যুতে প্রকল্পগুলো এখনও ধুঁকছে। একই সঙ্গে গত ২০১৭ সালের জুনের মাঝামাঝি প্রথমবারের মতো তিনি সফলভাবে সব `অংশীজন` সমন্বয়ে একটি `সম্মিলিত` কর্মধারার মাধ্যমে ঢাকার জলজট আর নগরবন্যা নিরসনে একটি জনসম্পৃক্ত কর্মভিত্তিক আন্দোলনের রূপরেখা তৈরি করাতে পেরেছিলেন। সরকারের স্থানীয় সরকার ও সমবায়মন্ত্রী সেই দায়িত্বপূর্ণ নেতৃত্ব গ্রহণে প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন। তার পর্যায়ক্রমিক ধারাবাহিকতা নিশ্চিতের পূর্বেই পরের মাসে আনিসুল হক অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেই উদ্যোগ এখনও আলোর মুখ দেখার অপেক্ষায়। বরং চলছে সেই পুরনো পরস্পরবিরোধী বক্তব্য আর প্রকল্পের জোয়ারে সমস্যা সমাধানের ব্যর্থ চেষ্টা।
জনগণের প্রতি আনিসুল হকের সংবেদনশীলতা কিংবদন্তিতুল্য হয়ে উঠেছিল। গুলশান-১-এর বিপণিবিতানের অগ্নিদুর্ঘটনা কিংবা কড়াইল বস্তির অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে তাঁর কায়িক অংশগ্রহণ ও দ্রুত পরবর্তী পুনর্বাসন উদ্যোগ সে সাক্ষ্য বহন করে। সাক্ষ্য হয়ে থাকবে তাঁর সর্বশেষ সমাপ্ত প্রকল্প `বনানী কবরস্থান উন্নয়ন`। জাতির পিতার শহীদ পরিবার ও শহীদ তিন নেতার কবরসহ পুরো কবরস্থানকে পুনঃসংস্কারের প্রকল্পটি মাত্র ৫ মাসে সম্পাদন করার মধ্য দিয়ে উদ্যোগ গ্রহণ ও প্রকল্প সময়ানুযায়ী সংবেদনশীলতায় বাস্তবায়ন তাঁর দক্ষতা ও কর্তব্যনিষ্ঠার উদাহরণস্বরূপ। প্রকল্পটির স্থপতি হিসেবে এটি আজও আমাদের উজ্জীবিত করে।
জনগণকে শুনতে, জানতে আর বুঝতে এক রকম আকুল হয়ে থাকতেন আনিসুল হক। এর ফলে `বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটির আরবান ল্যাব`-এর উদ্যোগে তিনি `নগর` নামে একটি মোবাইলভিত্তিক `অ্যাপ` তৈরি করান। `অ্যাপটি সাধারণ নাগরিককে ছবিসহ অভিযোগ করা আর তা পর্যায়ক্রমিক প্রতিকার না হলে মেয়র পর্যন্ত পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। এভাবে একান্তেই সিটি করপোরেশনকে এক স্বচ্ছ জবাবদিহিতে উপনীত করেছিলেন। `ডিজিটাল বাংলাদেশ` আন্দোলনকে কাজে লাগিয়ে জনসম্পৃক্ততার এই কর্মোদ্যোগ একটি `যুগভৈরবী` সৃষ্টি করেছিল। এসব কারণেই একজন আনিসুল হক মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে একটি `আস্থা`র নামে পরিণত হয়েছিলেন। আজও তাই মানুষটি আমাদের কাঁদায়। প্রতিজ্ঞায় মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে ধরার শক্তি জোগায়। সবাই মিললে `সমাধানযাত্রা` তাঁর সাফল্যের পঙ্ক্তিতে কবিতার ভোর ডেকে আনবে- এই অমিত সংকল্পে বলীয়ান করে।
৩০ নভেম্বর ২০১৭ সালে অকালমৃত্যু হয় আমাদের এই স্বপ্নবাজ নায়কের। এর সঙ্গে মৃত্যু হয় ক্রমধারায় জনবান্ধব `উচ্চাভিলাষী` উদ্যোগের। বেঁচে থাকলে এটির স্থবিরতা এই মানুষটি কিছুতেই মানতে পারতেন না। এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস। `মৃত্যু মানে বিরতি নয়`। আনিসুল হক রেখে গেছেন কিছু স্বপ্ন, চিন্তা ও কাজ। আমরা তার পরম্পরা তৈরি করে `সমাধানযাত্রা` নিরন্তর রাখব- এই হোক আমাদের অঙ্গীকার। `নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে,/ রয়েছ নয়নে নয়নে।/ হৃদয় তোমারে পায় না জানিতে।`
লেখক: নগরবিদ
এসি
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।